পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-২৩)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৯:৪০:৩৭ রাত
ক্লাস করছিলাম একটা আধটা। চিন্তা ভাবনায় দখল নিচ্ছে দিন বদলের টান। আরেক প্রেম। তার শক্তি অকল্পনীয়। তবু কখনো দ্বিধা জাগতো।
মিথিলা বাবু!
সেদিন মন বিক্ষিপ্ত ছিল। ক্লাসটা করার ইচ্ছে ছিল না। ক্লাস শুরুর আগেই বের হয়ে যাচ্ছিলাম। যিনি ক্লাস নিতে আসছিলেন তিনি আমাকে ফিরে ডেকে দাঁড় করালেন। ঠিক জানি না কী কারণে তিনি আমার চোখ দেখেই খুব রেগে গেলেন। ক্লাস টাইমের অর্ধেকটা ক্লাসের দরজার সামনেই কাটিয়ে ফেললেন আমাকে সাদা ভাষায় গালাগাল করে। তিনি কারো কাছে রাজনীতির সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে শুনেছেন। ভিন্ন পার্টির মানুষ। পার্টি গত কারণে এমনিতেই তার সাথে আমার সম্পর্ক সাপে নেউলে। তার ওপর উনার ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কুকীর্তি আমি জানতাম। উনার ক্লাস ছেড়ে আমার যাওয়াটা উনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে ফেলেছেন। উনার কথার কোন লাগাম রইল না। আমি চোখ নামিয়ে ঝিম মেরে শুনলাম সব। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কাউকে আর কিছু বলবো না প্রমিস করেছিলাম নিজের কাছে। আর, ক্লাসের সবার সামনে শিক্ষককে অপমান করতে ও মন সায় দিল না। কিন্তু কানে গরম সীসা ঢালা শব্দগুলি আমার ভিতরটাকে একটা এটম বোমায় রূপান্তরিত করল। আমি চোখ মাটিতে রেখেই মনে মনে শপথ করলাম, প্রথম সুযোগেই উপযুক্ত জবাব দেবো, পরের মিটিং এ সাদেক ভাইকে বলবো আজকের ব্যাপারে। তিনি কথা শেষে যখন আমাকে ক্লাসে যেতে বললেন একবার ভাবলাম মুখের উপর 'না ' বলে দিই। শেষ মূহুর্তে কি জানি কেন সিদ্ধান্ত বদলে ক্লাসে গেলাম। বাকিটা সময় রাগে সিদ্ধ হয়ে যাওয়া ব্রেইনটা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম। উল্টে আরো মাথা খারাপ হয়ে গেল উনার শব্দে। ক্লাস শেষে তিনি বের হওয়ার পর ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলাম। একেবারে ক্যাম্পাস ছেড়ে বাইরে।
দিন যেদিন খারাপ যায় সেদিন যেতেই থাকে। রাস্তায় নামার সাথে সাথে একটা রিক্সা দেখলাম অন্য পাশের ফুটপাথে সওয়ারি নামিয়ে দিল। মহিলা ব্যাগ থেকে টাকা বের করার সময় একটা নোট উড়ে নিচে পড়ল, দেখলেন না। তিনি ভাড়া মিটিয়ে গলিতে নেমে চলে যাওয়ার পর রিক্সাওয়ালা খুব দ্রুত টাকাটা তুলে কোমরে রাখল। মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল। রাস্তা পার হয়ে গিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম,'কত টাকা ছিল? ' লোকটা চমকাল কিন্তু স্বীকার করল না। না বোঝার ভান করে বলল, ' ভাড়া?' বললাম, 'উনার ব্যাগ থেকে পড়া নোটটা কত টাকার ছিল?' লোকটা উদাস ভংগি করে বলল,'কোথায় টাকা পড়ল?' তার প্রশ্ন আর প্রশ্ন করার ধরণে মন চাইল স্যান্ডেল খুলে চড় দিই। কিন্তু বিড়ালচোখী লোকটার মুখটা দেখে শয়তানের কথা মনে এলো। আমার চোখে দেখা ঘটনাটা প্রমান করার কোন পথ নাই বুঝে প্রচন্ড বিতৃষ্ণায় অসুস্থ লাগল। রিক্সাওয়ালা শয়তানি হাসি মুখে নিয়ে রিক্সায় উঠে প্যাডেল ঘুরাল। দরাজ গলায় গান গাইতে গাইতে চলে গেল। 'ইবলিস! ' অসহ্য লাগল সব। 'এই লোক কোন শ্রেণীতে পড়ে?'
রাতে রিক্সা জমা দেয়ার পর ল্যাম্প পোস্টের আলোয় রাস্তার পাশে খালি মাঠে গোল হয়ে
বসে জুয়ার আড্ডায় এইসব রিক্সাওয়ালাকেই নিশ্চয় দেখেছি এক একদিন। তাদের বউগুলি মানুষের ঘরে কাজ করে, ছেলেমেয়েগুলি নোংরা ময়লা চেহারায়- ছেঁড়া কাপড়ে পথে ঘাটে ঘোরে, চায়ের দোকানের সামনে হ্যাংলার মত হাত পাতে, মানুষের হাত টেনে, কাপড় টেনে নাছোড় বান্দা হয়ে লোকের কাছ থেকে পয়সা বা খাবার আদায় করে। অবিবেচকের মত আরেকজনের খাবার কেড়ে খায়। এরা কি সুবিধাবঞ্চিত! চাবকিয়ে পিঠের ছাল নিয়ে ফেলতে পারতাম! এদের জন্য কিছু করার কোন মানে হয়!
আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত। হলে ফিরে চললাম।
বিকালে হলের বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম, ভাবছিলাম, ' কী হবে এই দেশের? অসৎ, বিবেকহীন মানুষে ভরা দেশটা! কে এসে বদলাবে? কিভাবে বদলাবে?
বদলাবেই না!
মোফাখখার চৌধুরীর কথা মনে পড়ল। মনে আশা হল,' হয়তো এখনো কিছু মানুষ আছে।' উনার স্বর কানে বেজে উঠল। বলেছিলেন,' আমরা এই পথে নিজেদের জন্য আসি নাই। আমরা নিজেদেরকে দেশের শ্রেণীহীন মানুষের জন্য যেভাবেই হোক বাছাই হয়ে এসেছি। তাই আজ থেকে নিজেদের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে হবে। এ দেশ আমার, এ মাটি আমার, এ দেশের ছিন্নমুল মানুষ আমার। তাই তাদের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করার দৃঢ় শপথ নিতে হবে। এই পথে এসে অনেক অর্থ-বিত্ত এবং শক্তির সামনে নিজেকে পেয়ে নিজেরাই যেন আবার শোষিতের ভূমিকায় কেউ অবতীর্ণ না হই। '
ভাবতে থাকলাম,' শোষকের চেহারা কত রকম!'
একদিন হলে ছোটখালা এসে উপস্থিত! বাইরে ছিলাম। অন্যদিন বেশ রাত করে ফিরি। সেদিন কি কারণে সন্ধ্যায় ফিরলাম। খালা আমাকে পেয়েই বকতে শুরু করলেন। 'এই বয়সে এত ঘোরাঘুরি কিসের? কতক্ষণ বসে আছি। এখনি চলে যেতাম। তোকে না পেলে আর তোর মুখ দেখতাম না.. '
আমি হাসলাম। ছেলেদের হলে মহিলাদের অপেক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেই। ভিতরে যাওয়ার ও না। খালা দাঁড়িয়ে আছেন এতগুলি ঘন্টা! ছুটোছুটি করে একটা টুলের ব্যবস্থা হল, এক প্যাকেট বিস্কিট,চা ও।
বসে শান্ত হয়ে চা বিস্কিট খেয়ে খালা দ্বিতীয় পর্ব বকা শুরু করলেন। পারিবারিক পর্ব শেষ হওয়ার পর রাজনীতি পর্বে এসেই গলা নামিয়ে ফেললেন। প্রায় ফিসফিস করে বললেন, 'পাশে এসে দাঁড়া, তুই নাকি রাজনীতি করিস? আর কোন অকাজ বাকি রাখবি না? ভয় ডর নাই তোর? আর করবি তো নাস্তিকের রাজনীতি কেন করবি? মরার ব্যবস্থাও করবি, আর মরলে যেখানে যাবি সেখানকার ও বারোটা বাজিয়ে রাখবি? কি বুঝে করলি এই কাজ? তোর খালুর কাজ, না? আমি জানতাম, ও আমার চৌদ্দ পুরুষের সর্বনাশ না করে ছাড়বে না!' বলে একেবারে গুম হয়ে বসে থাকলেন।'
বলতে চাইলাম, ' এখানে খালুর দোষ নেই '
খালা একদম রেগে লাল হয়ে গেলেন, 'আমি সব জানি। এখন এক গোয়ালের গরু, একজন আরেকজনকে বাঁচাবি তো। শেষ পর্যন্ত কেউ বাঁচবি তোরা! ' খালার গলা কেঁপে গেল।
আমি বুঝলাম না, এই কথার পর খালা কেন মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে শুরু করলেন। হয়তো দুশ্চিন্তায়। হয়তো অন্য কিছু। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলাম,' খালুকে দেখতে গিয়েছিলে? ' আমার দেখার ভুল কিনা জানিনা, কোথায় একটা চেনা ভংগি মনে হল। প্রেম! খালা কান্না চোখেই হঠাৎ উঠে রওয়ানা দিলেন, ' আমি যাই, তুই এসব ছেড়ে দিবি, আর কিছু শুনবো না!'
আমি অনেক কষ্টে খালার সাথে রাস্তায় উঠে এলাম। এত দ্রুত কেউ হাটে! বললাম, 'কোথায় যাবে? ' চাপা গলায় বললেন, ' তোদের বাসায়। বাবু ওখানে।' আমি রিক্সা ডেকে খালার পাশে উঠে বসলাম। খালা মুখের আঁচল সরিয়ে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন,' তুই অনেক বদলে গেছিস! কয়দিন আগে ও ডাকলে কাছে আসতি না!' হেসে ফেললাম, 'রাতে একা যাবে? আমি দিয়ে আসি।' খালা খুশি হলেন, 'তা ঠিক আছে। রাত্রে থাকবি? ' আমি মাথা নাড়লাম, 'পারবো না খালা'। খালা একটু জোর করলেন। আমার ও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু মধ্য রাতে মায়ের কান্না আর বাদলের কাতর স্বর মনে পড়ে শিউরে উঠলাম, 'না! পারবো না!'
আমাদের মন এমন কেন! রিক্সাওয়ালাকে পার হয়ে চোখ চলমান পথের দৃশ্যে নিবিড় ডুব দিল। ভাবছিলাম, 'কারো কষ্টের ভাগ নিতে জানি না। কারো কষ্ট কমাতে জানি না। বিচ্ছিন্ন এই জীবন! '
.....
খেতে বসে খালা মাকে জিজ্ঞেস করল, 'তুমি এত চুপ হয়ে আছ কেন? ' আমি তাকালাম মায়ের দিকে। চোখের চারপাশে ঘন কালো ছোপ। মুখে অযত্নের ছাপ। কান্নার ভাজ মুখের রেখায় স্থায়ী হয়ে গেছে। দৃষ্টি অস্বাভাবিক। মা কথা বললেন না। খাওয়া ফেলে চলে গেলেন। খালা আবার কাঁদতে শুরু করলেন, 'কি হয়ে গেল! আল্লাহ কি করল? কি দোষ করলাম? কার দোষে এই হাল হয়ে গেল? ' বাবা তার স্বভাবমত মৃদু স্বরে খালাকে সান্ত্বনা দিলেন,' ভালো মন্দ জীবনে থাকেই। কে ভালো আছে? '
খালা ক্ষুব্ধ গলায় জিজ্ঞেস করলেন,' কেউ নাই? অনেকেই আছে। যারা থাকতে জানে না তারাই নাই!' বাবার মুখে হাসি ফুটতে দেখলাম, ' তুমিও তো জানলে না '
আমার কেমন অস্বস্তি লাগল। কেন জানি না। কি যেন বুঝতে পারছিলাম না। বাবাকে খালার সাথে ঠাট্টা করতে আগেও অনেক দেখেছি। কিন্তু মনে হল, কিছু নতুন। খালার মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। এটাও নতুন, খালা প্রতিবাদ করলেন না! মাথা নিচু করে খেতে লাগলেন। আমি সরে এলাম।
মা ছোটরুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পাথরের মত চোখে বাদলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ফিরে মা বাবার রুমে তাকিয়ে দেখলাম আলনায় মায়ের কোন কাপড় নেই! বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল! সতর্ক সংকেত দিল মন। যে কোনভাবেই হোক, কয়েকদিন আমাকে বাসায় থাকতে হবে।
বের হওয়ার আগে বাবাকে বললাম, 'আমি কয়েকদিনের জন্য বাসায় আসবো। বাবা একটু সংকুচিত হলেন। হ্যা, না - কিছুই বললেন না।
আমি বের হয়ে হলের দিকে রওনা দিলাম।
রাত নিঝুম। লাভলিদের বাড়ির পাহারা আলোটা ছাড়া সব আলো নিভানো। লাভলি অনেক দূরের এক আলো ঝলমল শহরে।
একা হেঁটে যেতে যেতে লাইট পোস্ট দেখি..
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন